শাইখুল আরব ওয়াল আজম আল্লামা হাজী মুহাম্মদ ইউনুস রহঃ স্মৃতি, শ্রদ্ধা ও মুগ্ধতা

শাইখুল মাকুলাত কারী মুহাম্মদ ইলিয়াস
কারী মুহাম্মদ ইলিয়াস। দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার একসময়কার তুখোড়, মেধাবী ও মমতাজ ছাত্র। দারুল উলুম দেওবন্দের সাবেক উস্তাদ, শাইখুল মাকুলাত ওয়াল মানকুলাত মাওলানা রাসুল খান রহ. ও শাইখুত তাফসির মাওলানা ইদরীস কান্ধলভী রহ. এর অত্যন্ত প্রিয়ভাজন শিষ্য। জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার সাবেক মহাপরিচালক শাইখুল আরব ওয়াল-আজম আলহাজ মাওলানা শাহ মুহাম্মদ ইউনুস (প্রকাশ, হাজী সাহেব হুজুর) রহ. এর শ্বশুর ও পীর খলিফায়ে গাঙ্গোহী শাইখুল মাশায়েখ মাওলানা জমিরুদ্দীন রহ. তাঁর দাদা। এই সূত্রে হাজী সাহেব হুজুর রহ.
তাঁর ফুফা হন। জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ায় হাজী সাহেব হুজুরের দীর্ঘ ১৯ বছরের একান্ত সহকর্মীও ছিলেন তৎকালীন এই জামিয়ার শাইখুল মাকুলাত কারী মুহাম্মদ ইলিয়াস। হাজী সাহেব হুজুর সম্পর্কে তিনি যে অভিব্যক্তি জানিয়েছেন, তা এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো।
মাওলানা হাজী মুহাম্মদ ইউনুস রহ. বড় উঁচু মাপের একজন সম্মানী ব্যক্তিত্ব। তিনি আমার দাদাজী শাইখুল মাশায়েখ মাওলান জমীরুদ্দীন রহ. এর জামাতা ও খাস খলিফা। ছোটবেলায় আমরা দেখেছি, তিনি সবসময় দাদাজীর খেদমতে নিয়োজিত থাকতেন। আমাদের ঘরের হাটবাজার এমনকি ঈদের বাজারও তিনি করে দিতেন। দাদাজীর ইন্তেকালের পর আমার দাদীর দেখাশুনা করতেন এবং ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র কিনে দিতেন। শাশুড়ি হিসেবে তাঁকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এবং শনিবার ভোরে তিনি আমাদের বাড়িতে আসতেন। সবার খোঁজখবর নিতেন। তাঁর মাঝে খেদমতে খালকের আজিব জজবা ছিল!
তাঁর আরেকটি গুণ হল 'ইবাদতপছন্দ'। জামাতের খুব পাবন্দ ছিলেন। শৈশবের একটা স্মৃতি মনে আছে। আমি তখন সবেমাত্র 'বেহেশতি জেওর' ও অন্যান্য ছোটখাটো কয়েকটি কিতাব পড়েছি। রমজানের পর একবার তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হয়। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এ বছর তারাবি কোথায় পড়িয়েছ? আমি বললাম, অসুস্থতার কারণে আমি এ বছর তারাবি পড়াতে পারি নি। তিনি বললেন, আমাদের চার ইমামের এক ইমাম হলেন ইমাম শাফেয়ি রহ। তাঁর ৭টি রোগ ছিল। প্রত্যেকটা রোগ এমন যে, যার একটাই মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট। তাঁর কাছে কেউ কোন মাসআলা জিজ্ঞেস করলে তিনি এই মাসআলার সমাধানের জন্য প্রথমে কুরআনে কারিমের 'আলিফ লাম মিম' থেকে সূরা 'নাস' পর্যন্ত সাতবার খতম করতেন। এর কারণ হল, একটা রোগের কারণে মস্তিষ্কে যে খলল পয়দা হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে একবার। এভাবে সাতটা রোগের কারণে সাতবার পুরো কুরআন খতম করতেন।' তো তিনি আমাকে বোঝাতে চেয়েছেন যে, তুমি একটু কষ্ট করে খতম তারাবি পড়ালে তেমন কোন সমস্যা হত বলে মনে হয় না।
তাঁর আরেকটি গুণ হল আমানতদারি। তিনি আমিন ছিলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের লকবও ছিল আমিন। আরবের কাফেররা পর্যন্ত তাঁকে মুহাম্মদ আল-আমিন বলত। এই গুনটি হাজী ইউনুস সাহেবের মাঝে পুরোপুরি বিদ্যমান ছিল। তাঁর কাছে দীনী খেদমত হিসেবে সব মাদরাসা সমান ছিল। মাদরাসার জন্য যখন চাঁদা তুলতে বিদেশ যেতেন, তখন পটিয়ার জন্য যেমন চাঁদা তুলতেন তেমনি হাটহাজারী, নাজিরহাটসহ বহু মাদরাসার জন্য চাঁদা তুলতেন। বিদেশ থেকে এসে যেসব মাদরাসার জন্য চাঁদা তুলেছেন সেসব মাদরাসার মুহতামিমদের ডেকে এনে তাদের হাতে টাকাগুলো তুলে দিতেন। হাটহাজারী মাদরাসার জন্য আমার মাধ্যমে অনেকবার টাকা পাঠিয়েছেন। সে সময়ের বড় অংকের টাকা। কখনো দশ হাজার, কখনো পনের হাজার, কখনো বা ত্রিশ হাজার; এরকম অনেক টাকা পাঠিয়েছেন। এ ধরণের আমানতদারি এখন বে-নজীর। তিনি বাস্তবিকই একজন 'দীনপছন্দ' ব্যাক্তি ছিলেন। ছিলেন মসজিদ-মাদরাসার 'খায়েরখাহ' ও হিতাকাঙ্খী। আগামী প্রজন্মের জন্য তাঁর এই প্রোজ্জ্বল গুণগুলো আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে। অনুলিখন- সাঈদ হোসাইন