কৌশলের অংশ হিসেবে ২০ দল ছেড়েছে ইসলামী ঐক্যজোট, আ’লীগের সাথে ঐক্য নয়।ইসলামী ঐক্যজোটের সংগ্রামী মহাসচিব- আল্লামা মুফতি ফয়জুল্লাহ

কওমী উলামায়ে কেরামের আস্থাবাজন  বীর সিপাহসালার, জননেতা আল্লামা মুফতি ফয়জুল্লাহ সাহেবের সাক্ষাতকার।
দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকায় একান্ত সাক্ষাৎকারে, ২৩ জানুয়ারি ২০১৬,শনিবার।


একক কোনো কারণে নয়; বরং অনেক পরিকল্পনা ও কৌশলের অংশ হিসেবে ইসলামী ঐক্যজোট ২০ দলীয় জোট ছেড়েছে।  তবে নীতিগত কারণে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন জোটে যাওয়ার সম্ভাবনা ইসলামী ঐক্যজোটের নেই। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে ১৭ বছর থাকা ইসলামী ঐক্যজোট মনে করে, আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিএনপিকে আরো পরিপক্বতার পরিচয় দিতে হবে। এখন যে আন্দোলন চলছে সেটাতে
বিএনপির কৌশলের ঘাটতি আছে। জোটের শরিক বিশেষ করে ইসলামী দল ও শক্তিকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি। অবশ্য পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে বিএনপির সাথে আবার জোট গড়ার ব্যাপারে ইসলামী ঐক্যজোটের সর্বোচ্চ ফোরাম আবার বিবেচনা করতে পারে বলে জানিয়েছেন ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে নয়া
দিগন্তের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারে তিনি আরো বলেন, বর্তমানে দেশে যে রাজনৈতিক সঙ্কট চলছে তার সমাধানে সবার অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে হবে।
উল্লেøখ্য, ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক মরহুম মুফতি ফজলুল হক আমিনী প্রতিষ্ঠিত ইসলামী ঐক্যজোট গত ৭
জানুয়ারি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে জাতীয় কাউন্সিলে ২০ দলীয় জোটের সাথে নিজেদের সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেয়। তবে জোট ছাড়ার কারণ হিসেবে সম্মেলনে বিস্তারিত কিছুই জানানো হয়নি। মান-অভিমান, জোটে যথার্থ মূল্যায়ন না হওয়া, সরকারি মহলের  জোট ভাঙার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে চাপের মুখে ইসলামী ঐক্যজোট দীর্ঘদিনের মিত্র বিএনপি জোট থেকে বের হয়ে এসেছে বলে গুঞ্জন রয়েছে। 
নিম্নে সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।
 নয়াদিগন্ত : হঠাৎ করে এমন কী ঘটল যে আপনারা ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করলেন? 
মুফতি ফয়জুল্লাহ : অনেকগুলো পরিকল্পনা ও কৌশলের অংশ হিসেবে ইসলামী ঐক্যজোট ২০ দলীয় জোট  ছেড়েছে। একক কোনো কারণে জোট ছাড়েনি এটা পরিষ্কারভাবে বলতে পারি। তারপরও মূল কারণ হিসেবে যেটা বলব, সেটা হচ্ছেÑ ইসলামী ঐক্যজোট মনে করে, সব ইসলামী দল-সংগঠন, ইসলামি ব্যক্তিত্ব, উলামায়ে কেরাম এবং ইসলামি মনস্ক মানুষ সবার সমন্বয়ে একটিঐক্যবদ্ধ প্লাটফরম হওয়া দরকার। আমরা মনে করি, শুধু এই ঐক্য গড়ে তোলার জন্য এবং নিজেদের স্বতন্ত্র, স্বকীয় অবস্থান যেটা আমরা রাখি, স্বাধীন রাজনীতি করার যে অধিকার আমাদের আছে এগুলো সামনে রেখেই ইসলামী ঐক্যজোট এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
নয়া দিগন্ত : বিএনপি থেকেওতো বলা হচ্ছিল ইসলামি দল বা শরিক দলগুলোর সাথে বিএনপির ঐক্য ইস্যুভিত্তিক বিশেষ করে নির্বাচন ও আন্দোলনের জোট। আলাদা দল হিসেবেতো আপনারা দলীয় আদর্শের রাজনীতি এমনিতেই চালিয়ে যেতে পারছিলেন। সে ক্ষেত্রে জোট ত্যাগের প্রয়োজন পড়ল কেন?
মুফতি ফয়জুল্লাহ : চারদলীয় জোট যখন গঠন করা হয় তখন আমাদের মধ্যে কথা ছিল ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ও নির্বাচন এবং ঐক্যবদ্ধ সরকার গঠন। এসব জায়গায় কিছু কিছু সময় ব্যত্যয় ঘটছে। তা ছাড়া যেসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ইসলামী ঐক্যজোট গঠিত হয়েছে এবং অপরাপর ইসলামি দল যে চিন্তাভাবনা ও আদর্শ লালন করে সেটা হচ্ছে ইসলামি আদর্শ। আমরা মনে করি যে আদর্শিকভাবে যদি এ ব্যাপারে কোনো সমস্যা তৈরি হয় সে ক্ষেত্রে ইসলামী ঐক্যজোট স্বতন্ত্র ও স্বকীয় অবস্থান নেয়ার সুযোগ ও অধিকার রাখে।
নয়া দিগন্ত : তার মানে জোটের মধ্যে থেকেও আপনারা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছিলেন বা জোটে যথাযথ
মূল্যায়ন পাচ্ছিলেন না, যার কারণে জোট ছেড়েছেন?
মুফতি ফয়জুল্লাহ : আমাদের মান-অভিমান, অভিযোগ-অনুযোগ কোনো কিছুর কথাই বলতে চাই না। শুধু বলতে চাই ইসলামী  ঐক্যজোটের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করা, লক্ষ্য আদর্শ বাস্তবায়নকে আরো ত্বরান্বিত করা এবং ইসলামি সমমনা যেসব দল আছে যারা দেশে ইনসাফভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করতে চায় তাদের নিয়ে একটা ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামি সমাজব্যবস্থা  কায়েমের স্বপ্ন দেখি। এ লক্ষ্য নিয়েই  আমরা বের হয়ে গেছি। কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই।
নয়া দিগন্ত : বিএনপি ইসলামী ঐক্যজোটকে তাদের জোটে বোঝা হিসেবে মনে করছেÑ এমন কথা বিএনপির কোনো
দায়িত্বশীল নেতা নাকি আপনাদের কোনো শীর্ষ নেতাকে বলেছিলেন। এটা কতটুকু সত্য এবং এগুলোর কোনো প্রভাব আপনাদের জোট ছাড়ার ক্ষেত্রে পড়েছে কিনা ?
মুফতি ফয়জুল্লাহ : এটা মিডিয়ায় এসেছে।
আমি এগুলো উচ্চারণ করতে চাই না। এ বিষয়গুলো অত্যন্ত লজ্জাজনক, এটা অবমাননাকর যেসব শব্দ মিডিয়ায় এসেছে, যেগুলো শোনা গেছে। আমি এগুলো সম্পর্কে কিছুই বলব না।
নয়া দিগন্ত : ২০ দলীয় জোটের কার্যক্রম
সেভাবে চলছে না মর্মে ইসলামী ঐক্যজোটের আমির মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামী সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেছেন এবং জোট ছাড়ার পেছনে এটাও প্রভাব ফেলেছে বলে জানিয়েছিলেন।
মুফতি ফয়জুল্লাহ : উনি যথাথই বলেছেন। আমিও এটা মনে করি যে, ২০ দল যেটাকে
বলা হয়, মুফতি ফয়জুল্লাহ : আমি আগেই বলে রাখি যে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সাথে আমাদের নীতিগত বিরোধ আছে। তাদের সাথে আমাদের ঐক্যের কোনো সম্ভাবনা নেই। আমরা মনে করি বিএনপিকেও ইসলাম, মুসলমান, ইসলামি স্বার্থের পক্ষে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে, ইসলামি দল জোট শক্তিকে মূল্যায়ন করতে হবে। বুঝতে হবে এ দেশের মূল শক্তি হচ্ছে ইসলামি শক্তি। তারা দ্বিধা বিভক্ত আছে, হয়তো সে কারণে সেই শক্তিটা সেভাবে প্রদর্শিত হয় না। এটা সবাইকে বুঝতে হবে। ক্ষমতায় থাকতে হলেও ইসলামি শক্তির প্রয়োজন, ক্ষমতায়, যেতে হলেও ইসলামি শক্তির প্রয়োজন। আমরা মনে করি বিএনপি যদি ইসলাম ও মুসলমানের পক্ষে, এ দেশের মানুষের পক্ষে, এ দেশের স্বাধীনতা-অখণ্ডতা ও সমৃদ্ধির পক্ষে এবং গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন থাকে সে ক্ষেত্রে ইসলামী ঐক্যজোটের মসলিসে শূরা আবার তাদের সাথে ঐক্য গড়ে তোলার বিষয় বিবেচনা করতে পারে। আবারো বলতে চাই, নীতিগত কারণে আওয়ামী লীগের সাথে আমাদের জোট হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। পক্ষান্তরে পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে বিএনপির সাথে আবার জোট গড়ার ব্যাপারে ইসলামী ঐক্যজোটের সর্বোচ্চ ফোরাম আবার বিবেচনা করতে পারে। বের হওয়ার সিদ্ধান্ত যেমন নিয়েছে, তেমনি আবার জোটবদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্তও হতে পারে।

নয়া দিগন্ত : দেশের বর্তমান যে রাজনৈতিক অবস্থা তা যদি বহাল থাকে তাতে কি জোট থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পরও আপনাদের যে রাজনৈতিক আদর্শের কথা বলছেন সেটা বাবস্তবায়ন করতে পারবেন বলে মনে করেন?

মুফতি ফয়জুল্লাহ : আমি মনে করি দেশে এখন রাজনীতিশূন্য অবস্থা বিরাজ করছে। বাংলাদেশে এখন রাজনীতি নেই। মানুষের কথা বলার অধিকার নেই। ন্যায়বিচার নেই, ইনসাফ নেই এবং একটা বিশৃঙ্খল অবস্থা দেশে বিরাজ করছে। দেশের কোনো মানুষ আজ নিরাপদ- এ কথা বলার সুযোগ নেই। এটা কারো জন্যই কল্যাণকর নয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন হলো এটাকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে হয়েছে বলে ক্ষমতাসীনরা দাবি করছেন। তখন তারা বলেছিলেন, পরে সবার অংশগ্রহণে একটা নির্বাচন করবেন। আমরা মনে করি, ওই নির্বাচন সাংবিধানিকভাবে সিদ্ধ হলেও দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এই নির্বাচনটা গ্রহণযোগ্য হয়নি। বাংলাদেশের মানুষ এবং সারা পৃথিবী এটা গ্রহণ করেনি। অতএব সবার অংশগ্রহণে এবং অবাধ নিরপেক্ষভাবে একটা নির্বাচন করা অপরিহার্য। এ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মানুষের মানবিক অধিকার রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব। আমি মনে করি সরকার এ দিকেই অগ্রসর হবে। অত্যাচার, জুলুম, নিপীড়ন ও নির্যাতনের পথ সরকার পরিহার করবে।
নয়া দিগন্ত : আপনি বলছেন, দেশে অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে, দেশে রাজনীতি নেই। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এখন কী করা উচিত বলে মনে করেন।
মুফতি ফয়জুল্লাহ : আমি মনে করি, বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। সবার অংশগ্রহণে অবাধ নিরপেক্ষ একটা নির্বাচনের পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠন করতে হবে। এ দাবি আমরাও করছি, বাংলাদেশের সব মানুষের দাবিও এটাই। এ দাবি সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে করতে হবে। এ দাবিতে ইসলামী ঐক্যজোট আগে যেমন আন্দোলনে ছিল, এখনো আছে, আগামীতেও থাকবে।