মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আলেম সমাজের ভূমিকা

বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবস এলেই মুক্তিযুদ্ধের তথাকথিত চেতনাধারী বুদ্ধিজীবী নামক কিছু পরজীবী ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগেন। তারা পরোক্ষভাবে বলতে চান, '৭১-এ জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের যুদ্ধ নয়, ইসলামের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষতার যুদ্ধ হয়েছিল! প্রত্যক্ষভাবে তো প্রায়ই বলেন, এদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন প্রধানত ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। আর আলেম সমাজকে তারা বলেন, রাজাকার! বক্ষ্যমাণ নিবন্ধটি সেসব বুদ্ধিজীবীর (?) এসব দাবির অসারতা প্রমাণের সীমিত প্রয়াস।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাঃ যেসব বুদ্ধিজীবী (?) একাত্তরে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বলে দাবি করেন, তাদের এ দাবি বিভ্রান্তিকর, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও নির্জলা মিথ্যা। আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক ছয় দফা, ১৯৭০ সালে দলটির নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো অথবা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে মুজিবনগর সরকারের দলিলপত্রে কোথাও কি 'ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দটি খুঁজে পাওয়া যাবে? মূলত এ বাক্যটি সংবিধানে লিখে ধর্মপ্রাণ মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধে যারা 'শহীদ' হয়েছেন তাদের আত্মাকে কষ্ট দেওয়া হয়েছে। তথাকতিত সেসব বুদ্ধিজীবী আরো দাবি করছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল। এটি নিতান্তই সত্যের অপলাপ। মুক্তিযোদ্ধাদের যারা এখনো জীবিত আছেন তাদের মধ্যে একটি নিরপেক্ষ জরিপ চালালেই তাদের এ অন্তঃসারশূন্য দাবির মুখোশ উন্মোচন হয়ে যাবে। এটি মূলত এদেশ থেকে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র!
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী ছিল তা 'শহীদ' শব্দের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ থেকেই সুস্পষ্ট। ইসলামই তো অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা ছিল। কেননা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ইসলামই সবচে বেশি সোচ্চার। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে জুলুমের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। এমনকি জুলুম প্রতিরোধে ইসলামে জিহাদের বিধান রাখা হয়েছে। ইসলামের এই বিধানই ধর্মপ্রাণ মানুষের শিরায় শিরায় জ্বালিয়ে দিয়েছে প্রতিরোধের অগ্নিশিখা।
সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করছেন তাদের মধ্যে ৯৮ ভাগ ছিলেন মুসলমান, আর মৃত্যুভয়ে যারা এদেশ ত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের মধ্যে ৯৫ ভাগ ছিলেন হিন্দু। সুতরাং এই ৯৮ ভাগ মুসলমান ধর্মনিরপেক্ষ চেতনায় বিশ্বাসী ছিল বলে কেউ যদি দাবি করেন, তাহলে তা পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছু নয়। চরম সত্য হল, সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশই ধর্মনিরপেক্ষতা কী তা জানতেন না। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ সালে এদেশের মুসলমানরা ইসলামী চেতনায় জেগে ওঠে জালিমের বিরুদ্ধে জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং 'শহীদী মৃত্যু'র তামান্নায় নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করেছিল। বিজয়ের মাসে এই ইসলামী চেতনারই বিজয় ঘোষিত হোক, যার জন্য একাত্তরে অকাতরে বিলিয়ে দেয়া হয়েছিল লক্ষ প্রাণ। আর যারা চার দশক পরেও নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আবিষ্কারে গলদঘর্ম তাদের জন্য হোক, ধিক শত ধিক!
আলেম সমাজের ভূমিকাঃ মুক্তিযুদ্ধে আলেম সমাজের ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য। এখানে বাংলাদেশের দু'জন বিখ্যাত আলেমের অবিস্মরণীয় ভূমিকা তুলে ধরছি। প্রথমজন হলেন মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক গুরু মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী (রহঃ)। তিনি ছিলেন শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী (রহঃ)-এর একান্ত স্নেহভাজন শিষ্য এবং শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভী (রহঃ)-এর রাজনৈতিক চিন্তাধারায় বিশ্বাসী। এদেশের স্বাধীনতায় তাঁর ভূমিকা কী ছিল তা ১৭/১১/১২ ইং তারিখের 'দৈনিক আমার দেশ' পত্রিকা থেকে এখানে হুবহু তুলে ধরছি। ' ১৯৬৯-এর যে গণঅভ্যুত্থান পাকিস্তান সরকারকে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসন স্বীকার করতে এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দিতে বাধ্য করেছিল, সে গণঅভ্যুত্থানে প্রধান নেতার ভূমিকা ছিল মওলানা ভাসানীর। এদেশেরই কোনো কোনো নেতার প্রশ্নসাপেক্ষ ভূমিকায় স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়লেও মওলানা ভাসানী সমগ্র প্রদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছিলেন। স্বাধীনতামুখী সে অবস্থান থেকে জনগণকে আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় অঞ্চলে ১০ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যুর পর পাকিস্তান সরকার চরম উপেক্ষা দেখানো সত্ত্বেও আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দল যখন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত, ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ নেতা মওলানা ভাসানী তখন সরাসরি স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাক দিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানের জনসভায় তিনি সরাসরি স্বাধীনতার আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং পাকিস্তানের নির্বাচন বর্জন করে জোরদার করেছিলেন স্বাধীনতামুখী তৎপরতাকে। ১৯৭১ সালের মার্চে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদে স্বাধীনতার আহ্বানমুখে সোচ্চার ভাসানী প্রদেশের নির্বাচিত প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে সমঝোতা বৈঠক করার পরিবর্তে তার উচিত বাংলার সংগ্রামী নেতার ভূমিকা পালন করা। এক বিবৃতিতে মওলানা ভাসানী ঘোষণা করেছিলেন, ২৩ মার্চ থেকে পূর্ব বাংলা স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হবে।'
দ্বিতীয়জন হলেন এদেশের প্রখ্যাত আলেম ও বুজুর্গ মাওলানা মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর(রহঃ)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এ যুদ্ধ ইসলাম আর কুফরের যুদ্ধ নয়, এটা হল জালেম আর মজলুমের যুদ্ধ। পাকিস্তানীরা জালেম, এদেশের বাঙালিরা মজলুম। তাই সামর্থ্যের আলোকে সকলকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং এটাকে প্রধান কর্তব্য বলে মনে করতে হবে।’ তাঁর এই বিপ্লবী ফতোয়া শত শত আলেম ও ধর্মপ্রাণ মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে প্রাণপণে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস সঞ্চার করতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিল।
এদেশের আরো অসংখ্য আলেম ও পীর-মাশায়েখগণ মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহঃ) (তিনি মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে ইন্তেকাল করলেও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন), মা ওলানা আতহার আলী খান (রহঃ), খতিবে আজম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ্ (রহঃ), শাইখুল হাদীস মাওলানা আজিজুল হক (রহঃ), মাওলানা আতাউর রহমান খান (রহঃ), মাওলান লুৎফুর রহমান বরুণী (রহঃ), চরমোনাইর পীর মাওলানা ফজলুল করীম (রহঃ), মাওলানা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ (রহঃ), মাওলানা মুফতি নুরুল্লাহ (রহঃ), মাওলানা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী (রহঃ), মাওলানা শামসুদ্দিন কাসেমী (রহঃ) প্রমুখ।
সাংবাদিক শাকের হোসাইন শিবলি তার 'আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে' বইতে মুক্তিযুদ্ধে শত শত আলেমের যুগান্তকারী ভূমিকা ও সরাসরি অংশগ্রহণের রোমাঞ্চকর ইতিবৃত্ত তুলে ধরেছেন। এ বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে জলেমদের বিরুদ্ধে শত শত আলেমের অস্ত্র হাতে তুলে নেবার ইতিহাস। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আজ যাদের বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে এই বাংলার অস্তিত্ব, এদেশের মাটির পরতে পরতে যাদের খুন মিশ্রিত, মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী সেসব আলেম সমাজের কপালে তথাকথিত কিছু বুদ্ধিজীবী রাজাকারের 'কলঙ্ক তিলক' এঁকে দিতে চায়। এটি এদেশ থেকে ইসলামপন্থীদের সমূলে উৎপাটন করার ভয়ানক ষড়যন্ত্র! পিণ্ডির রাজাকাররা যেভাবে আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে সফল হয় নি, তেমনি এসব পরজীবীরাও তাদের ষড়যন্ত্রে সফল হবে না।
আমরা বলতে চাই, প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করতে হবে। সর্ষের ভূত তাড়ানোর জন্যে প্রয়োজনে মাঠে নামতে হবে আপামর জনতাকে। আর যারা উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চড়ানোর অশুভ পাঁয়তারা করছে, তাদের হাতে নাতে পাকড়াও করতে হবে। কারণ একটা কথা আছে 'চোর সচরাচর সাধুসন্তকেও চোরই ভাবে'। তাই এসব 'চোররা' কখনো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হতে পারে না।
দেশপ্রেমিক প্রতিটি ঈমানদীপ্ত নাগরিককে মনে রাখতে হবে, অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা আমদের স্বভাব। আজ আবার সময় এসেছে গর্জে ওঠার। যারা মুক্তিযুদ্ধের 'ইসলামী চেতনা'কে 'ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা' বলে বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালিয়ে এবং আলেম সমাজকে রাজাকার বলে অপবাদ দিয়ে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে চায় তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার। দল-মত নির্বিশেষে সিসা ঢালা দুর্ভেদ্য প্রাচীর গড়ে তুলতে হবে আমাদেরকে ইসলাম ও ইসলামপন্থী বিধ্বংসী তাদের সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন।